প্রতিটি রসিকতার দুটি দিক থাকে — একটিতে হাসি, আর অন্যটিতে প্রায়ই একটুখানি ক্ষতচিহ্ন।
গত এক দশক বা তারও বেশি সময় ধরে, ভারতীয় কৌতুকশিল্পীরা ক্রমশ তাদের ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্ট — দারিদ্র্য, ক্ষতি, প্রত্যাখ্যান এবং মানসিক স্বাস্থ্যের লড়াই — এই বিষয়গুলিকে ব্যবহার করছেন মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের, আরোগ্য লাভের এবং সামাজিক নিয়মকে চ্যালেঞ্জ করার উপকরণ হিসেবে।
এখানে পাঁচজন ভারতীয় কৌতুকশিল্পীর কথা বলা হলো, যারা তাদের সংগ্রামকে শক্তিতে রূপান্তর করেছেন — হাস্যরসকে করেছেন একদিকে ঢাল, অন্যদিকে এক নিরাময়শক্তি।
১. কপিল শর্মা: দারিদ্র্য, প্রত্যাখ্যান ও দৃঢ়তা
কপিল শর্মার গল্প প্রতিকূলতা থেকে জন্ম নেওয়া কৌতুকের প্রতীক।
সাধারণ পরিবারের সন্তান কপিল ছোটবেলাতেই আর্থিক সংকট ও একের পর এক ব্যর্থতার মুখোমুখি হন। বছর ঘুরে তিনি প্রকাশ্যে মানসিক অবসাদ ও আত্মসন্দেহের মতো সংগ্রামের কথা বলেছেন।
তাঁর বিশেষ অনুষ্ঠান I Am Not Done Yet-এ কপিল নিজের মানসিক স্বাস্থ্য, সাফল্যের ওঠানামা এবং জনসমালোচনাকে হাস্যরসের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন।
নিজের ভুলগুলো — মদ্যপ অবস্থায় টুইট, সংবাদমাধ্যমের সমালোচনা, ব্যক্তিগত ত্রুটি — এসব নিয়ে হাসতে পারার ক্ষমতা দর্শকদের তাঁর মানবিক দিকটা দেখায়।
২. বির দাস: বেতনহীন ইন্টার্নশিপ থেকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে
বির দাসের জীবনসংগ্রাম এক ক্লাসিক “নিচ থেকে উঠে আসা”র গল্প।
তিনি নিজেই বলেছেন, একসময় তাঁকে একসঙ্গে তিনটি কাজ করতে হতো — বেতনহীন ইন্টার্নশিপ, অদ্ভুত পার্ট-টাইম কাজ, আর কিছু কমিশন (যা প্রায়ই মেলেনি)।
একবার তিনি শিকাগোতে সম্পূর্ণ নিঃস্ব অবস্থায় পড়েছিলেন — ভাড়া দেওয়ার টাকা ছিল না, রাত দুটোর সময় মাত্র কয়েক ডলার হাতে নিয়ে ATM-এর বাইরে কেঁদেছিলেন।
তবুও বির দাস এসব স্মৃতিকে করুণা নয়, বরং কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করেন। তাঁর কৌতুক প্রায়ই ফিরে যায় সেই দিনগুলিতে — প্রবাসীর বিচ্ছিন্নতা, উদ্বেগ, আর দারিদ্র্য ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার হাস্যকর সংঘাত।
Vir Das: For India অনুষ্ঠানে তিনি শৈশবের ছবি, পরিবারের অদ্ভুত অভ্যাস, পারলে-জি বিস্কুটের মতো স্মৃতি ফিরিয়ে এনে সেগুলিকে সার্বজনীন করেছেন।
৩. মুনাওয়ার ফারুকি: দারিদ্র্য, ক্ষতি ও বেদনা থেকে লক্ষ্য খোঁজা
মুনাওয়ার ফারুকির জীবন শৈশব থেকেই দুঃখের সঙ্গে জড়িত।
গুজরাটের জুনাগঢ়ে ঋণে জর্জরিত পরিবারে বেড়ে ওঠা মুনাওয়ার পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থাতেই স্কুল ছেড়ে দেন। তাঁর মা সংসার চালাতে হিমশিম খেতেন; কখনও দিনে মাত্র ৩০ টাকায় চলতে হতো, তিনি বাসনপত্রের দোকানে কাজ করেছেন, দিদিমার সঙ্গে নাশতা বিক্রি করেছেন, এমনকি ঘরে গার্হস্থ্য হিংসাও দেখেছেন।
ফারুকির কৌতুক, যদিও অনেক সময় রাজনৈতিক ও তীক্ষ্ণ, গভীরভাবে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে — শোক, দায়িত্ব, ও স্থানচ্যুতি।
মঞ্চে ওঠার আগে হতাশার মুহূর্তগুলোকে তিনি বাস্তবতার মধ্যে রূপান্তর করেছেন — যেটির সঙ্গে দর্শকরা গভীরভাবে সংযোগ স্থাপন করেন।
৪. ভারতী সিং: শৈশবের ক্ষুধা, ক্ষতি এবং বেঁচে থাকার উপায় হিসেবে হাস্যরস
“লাফটার কুইন” নামে পরিচিত ভারতী সিং-এর জীবন অনেকের কাছেই ট্র্যাজিক মনে হতে পারে।
মাত্র দুই বছর বয়সে তিনি বাবাকে হারান। তাঁর পরিবার চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে যায় — তাঁর মা শৌচাগার পরিষ্কার করতেন, একাধিক ছোটখাটো কাজ করতেন; ভাইবোনেরা কম বেতনে কারখানায় ভারী কম্বল সেলাই করত, যেগুলো তারা নিজেরা ব্যবহার করতেও পারত না।
খাবার ছিল অপ্রতুল; অনেক দিনই বাসি খাবারই ছিল একমাত্র ভরসা।
তবুও ভারতী নিজের অতীতকে আড়াল করেননি। মঞ্চে ও মঞ্চের বাইরে, তিনি নিজেকে নিয়ে রসিকতা করেন — “মোটা মেয়ে” হিসেবে, “শৌচাগার পরিষ্কার করা মেয়ের মেয়ে” হিসেবে, কিংবা উৎসবের সময় ক্ষুধার কষ্ট নিয়ে।
তাঁর হাস্যরস শরীর, লজ্জা, ও সামাজিক ধারণাকে কেন্দ্র করে — যেখানে তিনি নিজেই গল্পের নিয়ন্ত্রণ নেন, যাতে অন্যেরা না পারে।
৫. কানন গিল: চাপ, পরিপূর্ণতার খোঁজ এবং আলোর সন্ধান
বাইরের দারিদ্র্য নয়, বরং ভেতরের সংগ্রামের গল্প এটি।
কানন গিল নিজের উপর বছরের পর বছর কঠোর ছিলেন, বাতিল শো-এর চিন্তা, “আমি যথেষ্ট নই” — এই ভাবনার উৎকণ্ঠা তিনি তাঁর নেটফ্লিক্স বিশেষ Yours Sincerely, Kanan Gill-এ রসিকতার আকারে তুলে ধরেছেন।
তাঁর হালকা ও অন্ধকার মুহূর্তগুলিকে তিনি ভারসাম্যপূর্ণভাবে উপস্থাপন করেন — ওজন বাড়া, অসুস্থতা, ব্যর্থতা, ভুল বোঝাবুঝি। নিজের দুর্বলতা ভাগ করে নিয়ে তিনি দর্শকদের নিজেদের প্রতিফলন দেখতে দেন।
তাদের বেদনা কীভাবে হাসির উপাদান হয়ে ওঠে
এই সব কৌতুকশিল্পীদের মধ্যে কয়েকটি মিল রয়েছে:
- ভঙ্গুরতা: তাঁরা কষ্ট লুকান না; বলেন “এই আমি”, এমনকি যখন তা অস্বস্তিকর হয়।
- আসলত্ব: তাঁদের কৌতুক কল্পনা নয়, জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে।
- রূপান্তর: গল্পটি যন্ত্রণায় আটকে থাকে না; বরং এগিয়ে যায় — আত্ম-স্বীকৃতি, আরোগ্য, এবং এক নতুন ভবিষ্যতের দিকে।
- ঝুঁকি: ব্যক্তিগত বেদনা প্রকাশ্যে আনলে সমালোচনা, প্রতিক্রিয়া, ও মানসিক চাপ আসতে পারে — তবুও তাঁরা সেই ঝুঁকি নেন।
আগামী দিনের দিকে: হাস্যরসের শক্তি ও তার মূল্য
ভারতে স্ট্যান্ড-আপ কমেডির উত্থান মানে অনেক নিষিদ্ধ বিষয় — গার্হস্থ্য হিংসা, দারিদ্র্য, মানসিক স্বাস্থ্য, ধর্মীয় টানাপোড়েন — নিয়ে খোলাখুলি কথা বলার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
এই কৌতুকশিল্পীরা শুধু মানুষকে হাসান না; তাঁরা আলোচনাকে স্বাভাবিক করছেন, অনুচ্চারিত ক্ষতগুলিকে কণ্ঠ দিচ্ছেন।
তবে এর মূল্যও আছে — মানসিক পরিশ্রম, ভুল বোঝাবুঝির ঝুঁকি, এবং “অতি রাজনৈতিক” বা “অতি বাস্তব” বলে তকমা পাওয়া।
কিছু শো বাতিল হয়, কিছু রসিকতা বিতর্ক তোলে।
অনেক কৌতুকশিল্পী নিজেদের সীমা ঠিক রাখার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন, যাতে তাঁদের ব্যক্তিগত সংগ্রাম তাঁদের সম্পূর্ণ গ্রাস না করে।
– সোনালি




